ভূমিকাঃ
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল একটি দেশ। নদীমাতৃক এদেশে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্যা নদ-নদী। তাই স্বভাবতই এদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় সেতু একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমে হিসেবে পরিচিত । বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী হলো পদ্মা। যেখানে পদ্মাসেতু নিমার্ণনের মাধ্যমে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অনেক বেশি গতিশীল করেছে।
দেশের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের লোকজনকে পদ্মা নদী পার হয়ে রাজধানী ঢাকায় আসা যাওয়া করতে হয়। পদ্মাসেতু নির্মাণের ফলে এই অঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের পথকে করেছে গতিশীল । করেছে সহজ ও কম সময়ে তারা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছে । পদ্মা সেতু নিমাণের ফলে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতির এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে । এসেছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনের গতি ।
পদ্মাসেতু এর ইতিহাস ও বর্ণনাঃ
বর্তমান সরকারের ২০০৮ সালের অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইশতেহার ছিল পদ্মা নদীতে একটা সেতু নির্মাণ। সেই ইশতেহারের ফসল বাংলাদেশের বর্তমান পদ্মা সেতু । আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করে। এজন্য বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা প্রভৃতি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সহায়তার প্রতিশ্রুতি পায় ।
কিন্তু পদ্মা সেতু নির্মাণের দুর্নীতির অজুহাত তুলে বিশ্বব্যাংক ঋণ দিতে অস্বীকৃতি জানায় । সাথে সাথে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো পদ্মা সেতু নির্মাণে ঋণ প্রদান থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর বিভিন্ন তর্ক-বির্তকের পর আওয়ামীলীগের সভা নেত্রী বর্তমান সরকার প্রধান শেখ হাসিনা মহান জাতীয় সংসদে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়ানে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন । তিনি শুধুমাত্র ঘোষণা দিয়ে থেমে যান নি । সেই সেতুর কাজ শেষ করেছেন । যা নির্মাণ করতে ৩.২ বিলিয়ন ডলার খচর করতে হয় ।
পদ্মা সেতুর পরিমাপঃ
পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার, প্রস্থ ১৮.১০ মিটার । মোট পিলার সংখ্যা ৪২ টি । ৪০টি নদীর মধ্যে ২টি সংযোগ সেতুর সাথে । পাইলের সংখ্যা ২৬৪ টি । নদীর ভেতরের ৪০টি পিলারে ৬টি করে মোট ২৪০টি এবং সেতুর দুই পাশের দুটি পিলাওে ১২ টি করে মোট ২৪টি পাইল আছে পিলারের উপর ৪১টি স্প্যান বসানো হয়েছে । সেতুর কাজ করেছে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড । পদ্মা সেতুর স্থায়িত্ব কাল ধরা হয়েছে ১০০ বছর । আর পদ্মাসেতুর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ।
পদ্মাসেতু ও জাতীয় উন্নয়ন:
জাতীয় উন্নয়ন বলতে মূলত একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নকে বোঋায় । শিক্ষা ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য এমনকি খেলাধুলার উন্নতি ও জাতীয় উন্নয়নে অংশ । এক কথায় কোনো সরকার বা নির্দিষ্ট এলাকার মানুষের সার্বিক উন্নয়নই জাতীয় উন্নয়ন । পদ্মাসেতু প্রধানত দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সাথে সমগ্র দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজীকরণের নিমিত্তে নির্মিত হয়েছে ।
দেশের অধিকাংশ উন্নয়ন কর্মকান্ড রাজধানী থেকে পরিচালিত হয় । কিন্তু এ উন্নয়নের সুবিধার দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছাতে পদ্মা নদী একটা বড় বাঁধা । সেতুটি নির্মিত হয়ে দেশের কেন্দ্রীয় সুবিধাসমূহ এবং এই সব এলাকার সম্ভব্য উন্নয়নে ত্বরান্বিত হয়েছে । পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা জাতীয় উন্নয়নে প্রভাবক । পদ্মা সেতু নির্মাণের দ্বারা সৃষ্ট যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে যে বিষয়গুলো জাতীয় উন্নয়নকে প্রভাবিত করতে পারেছে ।
এখন আর দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় তিন কোটি মানুষ ফেরী বা লঞ্চের উপর নির্ভরশীল নয় । আগে যেখানে এই পদ্মা পার হতে কয়েক ঘণ্টা সময় লেগে যেত সেখানে মাত্র দশ থেকে বারো মিনিটেই পদ্মা পার হতে পারছে । যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে এক যুগান্তকারী সূচনা ।
বেঁচে যাচ্ছে হাজার হাজার কর্ম ঘণ্টা যা আমাদের জাতীয় উন্নয়নে অনেক বেশি গুরুত্ব রাখছে । ব্যবসার ক্ষেত্রে মানুষ খুব অল্প সময়ে রাজধানীর সাথে যোগযোগ করতে পারছে । বিশেষ করে পচনশীল সবজি খুব অল্প সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রন্তে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে ।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় পদ্মাসেতুঃ
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বর্তমান অবস্থানে এসে পৌঁছেছে । এর মধ্যে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ অবশ্যই দেশের জন্য এক অকল্পনীয় ঘটনা বটে । এই সেতু নির্মাণ নিয়ে ঘটে গেছে অপ্রতাশিত নানা ঘটনা । কেউ কেউ মেতে উঠেছিল গভীর ষড়যন্ত্রে । কিন্তু সকল চক্রান্তের জাল ছিন্ন করে পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান হয়েছে । পদ্মা সেতুর নানান অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে ।
বিভিন্ন দিক থেকেই এই সেতু বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল ও অধিকতর চাঙ্গা করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে । এই সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষ ও পণ্য পরিবহনে বৈপ্লাবিক পরিদৃষ্ট হয়েছে । পদ্মা সেতু ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার যোগসূত্র স্থাপন করেছে । আগে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের শিল্পায়নের অবস্থা তেমন উন্নত ও যুগোপযোগী ছিল না । অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশ পেছনেই পড়ে ছিল দক্ষিণাঞ্চল । কিন্তু পদ্মাসেতু চালু হওয়ার পর এই অঞ্চলের কৃষিপণ্য খুব সহজেই দেশের অন্য প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে ।
যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে আমূল পরিবর্তন । যোগাযোগের কারণে নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠেছে । অর্থনীতিতে সামগ্রিকভাবে পরিবর্তন এসেছে । দক্ষিণাঞ্চলে অনেক বেশি পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে । যা ভ্রমণ প্রেমীদের অনেক বেশি আকৃষ্ট করে থাকে । সুন্দরবন, কুয়াকাটা, ষাটগম্বুজ মসজিদের মতো অনেক পর্যটন কেন্দ্র ওই অঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থায় কারণে অনেক পিছিয়ে ছিল । পদ্মা সেতুর মাধ্যমে এখন তা নাগালের মধ্যে চলে এসেছে ।
এসব পর্যটন কেন্দ্রের অবকাঠামোগত সাধন করে তা থেকে রাষ্ট্র প্রচুর আয় করতে সমর্থ হবে । নানা দিক বিবেচনায় বলতে পারি স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন পূরণের সারথি হিসেবে কাজ করছে । এদেশ নিজের অর্থায়নে এত বিশাল সেতু নির্মাণ করতে পেরেছে । ধীরে ধীরে আরও অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিজ অর্থেই সম্পন্ন করতে পেরেছে । পদ্মা সেতু নির্মাণ হওয়ার সাথে সাথে সাধারণ মানুষ এবং দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চালের জনগণের অর্থনৈতিক ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে ।
বিশেষ করে গ্রামীণ উন্নয়নশীল এলাকার বিশাল জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিব উন্নয়ন, সামাজিক উন্নয়ন জীবনমানের উন্নয়ন ও জ্ঞান মনোভাবের ব্যাপক পরিবর্তনে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতির বিকল্প নেই । যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । যোগাযোগ ব্যবস্থা ওপর নির্ভর করে একটি দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড আবর্তিত হয় ।
কৃষিক্ষেত্রে পদ্মাসেতুর গুরুত্বঃ
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার ফলে বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের গতিশীলতা এসেছে । ঘটেছে বৈপ্লাবিক পরিবর্তন । এর সরাসরি প্রভাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চালের ২১ জেলায় কৃষিতে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে এবং জেলাগুলোর রপ্তানিমূখী কৃষিভিত্তিক পণ্য অল্প সময়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠাতে পারছে । যার কারণে এ এলাকার কৃষক তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে এবং তাদের উৎপাদিত পণ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কমে আসছে ।
ফলে পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে । যে জেলাগুলো এই সেতু থেকে সরাসরি লাভবান হচ্ছে । খুলনা ও বাগেরহাটের মাছ, যশোরের সবজি আর ফুল, পটুয়াখালীর মুগডাল, তারমুজ, মাছ, মাদারীপুরের পেঁয়াজ, মসুর, সরিষা । বরিশালের ধান ও পানসহ নানাবিধ কৃষি পণ্য সরাসরি এর প্রভাব পড়বে । ধারণা করা হচ্ছে মাগুরার লিচু চাষিরাই প্রতি মৌসুমে অন্তত ৫০ কোটি টাকার বাড়তি লিচু বিক্রি করতে সক্ষম হবে । লিচুর পাশাপাশি মাগুরায় প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে সবজি চাষ, ১২ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ ও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জমিতে কাঁচামরিচের চাষ হয় ।
পাট, পেঁয়াজ আবাদে দেশের মধ্যে অন্যতম ফরিদপুর জেলা । এসব পণ্য দ্রুত ঢাকার বাজারে পাঠানো সম্ভব হবে । যশোর ও ফরিদপুরের খেজুরের গুড়ের কদর আছে দেশ জুড়ে । এখন অঞ্চলগুলোতে রপ্তানিমুখী কৃষিভিত্তিক পণ্যগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব । এসব পণ্য আন্তর্জাতিক মানদন্ড বজায় রেখে চাষাবাদ করা হচ্ছে । কৃষির উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি রপ্তানিমুখী কৃষিকে আরও সমৃদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা অতি দ্রুত গ্রহণ করতে হবে ।
চিংড়ি উৎপাদনের ৯০ শতাংশের ও বেশি উৎপাদিত হয় খুলনা বিভাগের জেলাগুলোতে প্রচলিত পদ্ধতিতে এই চিংড়ি খামারগুলোতে চিংড়ি চাষের উৎপাদনশীলতা অত্যন্ত কম । যা বর্তমানে হেক্টর প্রতি এক মেট্রিক টনের মতো । প্রচলিত প্রদ্ধতিতে এই চিংড়ি খামারগুলোতে আধা-নিবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করলে হেক্টর প্রতি উৎপাদন ৭ থেকে ৮ টনে উন্নতিকরণ সম্ভব । পদ্মা সেতু চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চিংড়ি চাষ এলাকায় ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে ।
পদ্মা সেতুর সুদূরপ্রসারী প্রভাব যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে স্থানীয় চাষিদের সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণির উদ্যোক্তাদের তথ্য ও জ্ঞানের আদান প্রদান হচ্ছে । এই সেতুকে ঘিরে ইত্যেমধ্যে আশেপাশের জেলাগুলোতে শুরু হয়েছে শিল্পায়ন, কৃষিতে এসেছে নতুন জোয়ার ।
পদ্মাসেতু ও বাংলাদেশর আর্থসামাজিক উন্নয়নঃ
আর্থসামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে পদ্মা সেতু অনেক বেশি ভূমিকা পালন করেছে । সেতুটি ঢাকার সাথে দেশের একুশটি জেলার সড়ক ও রেলযোগাযোগে আশাতীত সাফল্য বয়ে আনবে । সড়ক পথে সাফল্য এর মধ্যে এনেছে । রেল যোগাযোগ সম্পূর্ণ হলে যশোর থেকে ঢাকার দূরত্ব কমবে ১৭০ কিলোমিটার । তখন তিন ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা থেকে যশোর যাতায়াত করা যাবে ।
এক দশক ধরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের অধীর অপেক্ষার পালা শেষ হয়ে মানুষ এখন তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে পদ্মা সেতু । আর্থসামাজিক উন্নয়নের কারণে দেশের উদ্যোক্তরা দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছে । পর্যটন শিল্প থেকে শুরু করে আবাসন শিল্প, তাঁত শিল্প, হাইটেক পার্কসহ নানা ধরনের শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে । এরই মধ্যে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং ও শ্রনগর পাশাপাশি দুই উপজেলায় ও শরিয়তপুরের জাজিরা ও মাদারিপুরের শিবচর উপজেলায় বেশ বড় রকমের পরিবর্তন হয়েছে ।
যেখানে আগে দু,চারটি দোকান ছিল সেখানে গড়ে উঠেছে বহুতল মার্কেট, বিপণিবিতান, শত শত দোকান পাট । পদ্মা সেতু নিঃসন্দেহে দক্ষিণ এশিয়ার ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মধ্যে যোগাযোগ, বাণিজ্য বৃদ্ধিসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে । পদ্মাসেতুর কারণে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলা আরও গতিশীল হয়েছে । আর্থসামাজিক উন্নয়নের কারণে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা স্বল্প সময়ে পণ্য পরিবহন করে মোংলা বন্দরের মাধ্যমে রপ্তানি ও আমদানি করতে উৎসাহিত হচ্ছে ।
বাংলাদেশের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের অবকাঠামো সব সময় অবহেলিত ছিল। আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন একান্ত প্রয়োজন । দক্ষিণাঞ্চল সব সময় বন্যা প্রবণ অঞ্চল আধুনিক কলাকৌশাল ব্যবহার করে কীভাবে রাস্তাঘাটসহ বন্যা প্রতিরোধী অবকাঠামো নিমার্ণ করা যায় সেটা সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়নে অনেক বেশি কাজ করেবে ।
আপনি যখন দেখবেন আপনার এলাকায় অনেক বেশি অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে তখন আস্তে আস্তে আপনার এলাকার আর্থসামাজিক অনেক কাজ হবে । পদ্মা সেতু বাংলাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ একটা অবকাঠামো । এই অবকাঠামোকে কেন্দ্র করেই অঞ্চলের ব্যাপক পরিমাণে কাজ হচ্ছে ।
পদ্মাসেতু ও বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নঃ
পদ্মা সেতু তৈরির আগে এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে পদ্মা সেতু নিমার্ণের ফলে দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ অবদান রাখবে এ সেতু । আর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। ঢাকার সঙ্গে সহজ যাতায়াত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বাড়বে শিল্প কারখানায় বিনিয়োগ । গতি পাবে নগরায়ণ । কৃষিতে আসবে নতুন নতুন বিপ্লব । বাড়বে কর্মসংস্থান বিকশিত হবে পর্যটন ।
পদ্মা সেতুর প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী হবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তিন কোটির বেশি মনুষ । সেতুর জন্য করা নদী শাসন কাজ এ অঞ্চলে পদ্মার ভাঙন প্রবনতা কমাতে ভূমিকা রাখবে । কর্মসংস্থান, দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং পিছিয়ে থাকা অঞ্চলগুলোর উন্নয়নের মধ্য দিয়ে গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দারিদ্র্য কমবে । শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন নয়, উৎপাদন, কর্মসংস্থান, আায় বৃদ্ধি, দারিদ্র বিমোচনের মধ্য দিয়ে জাতীয় ও আঞ্চলিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে পদ্মা সেতু ।
পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দেশের জাতীয় জিডিপি প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি মানুষের আয়ে ১ দশমিক ৪ শতাংশ মূল্য সংযোজন হচ্ছে । এই উন্নয়ন কর্মকান্ডের ফলে ৭ লাখ ৪৩ হাজার ম্যান-ইয়ার সৃষ্টি করবে যা ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে । এসব প্রভাব পড়তে সেতু নির্মাণের ছয়-আট বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে । পদ্মা করিডোরে আন্তঃদেশীয় যোগাযোগ চালু হলে আরও গতিশীল হয়ে উঠবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতি ।
পদ্মা সেতুর মাধ্যমে সড়ক ও রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট ও টেলিকম পরিষেবার লাইন সংযোগ গড়ে তোলা হয়েছে । এসব পরিষেবা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্প-কারখানা বিকাশে বড় ভূমিকা রাখবে । অন্যদিকে সহজ উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবাদে আরও গতিশীল হয়ে উঠবে মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দর । সেতুর কারণে মোংলা ও পায়রা বন্দরের পণ্য খুব সহজে ঢাকায় নেওয়া যাচ্ছে । যার ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক বেশি অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে ।
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নঃ
উন্নয়নের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে । মহাসড়ক উন্নয়নে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধিনে প্রায় ২২ হাজার কিলোমিটার মহাসড়ক নেটওয়ার্ক রয়েছে । সরকার ২০০৯ থেকে বর্তমান মেয়াদে ৪৫৩ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক চারলেন বা তদোর্ধ্বে লেনে উন্নীত করেছে ।
এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গ, আটলেন বিশিষ্ট যাত্রাবাড়ি –কাঁচপুর চারলেন বিশিষ্ট ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ, নবীনগর ইপিজেড ঢাকা চন্দ্রা , গাজীপুর টাঙ্গাইলসহ বেশ কিছু মহাসড়কের কাজ শেষ হয়েছে । বর্তমানে ৪৪১ কিলোমিটার সড়ক উভয়পার্শ্বে পৃথক সার্ভিস লেনসহ এবং ১৭৬ কিলোমিটার ব্যতীত চার লেনে উন্নীতকরণের কাজ চলমান । পদ্মাসেতু শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয় পুরো বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেক বেশি পরিমাণে উন্নত সাধন করেছে এবং করবে ।
আরও বিশাদভাবে বলতে গেলে এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। রেল যোগাযোগ স্থাপন হলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার আরও আসবে গতি । পদ্মা সেতু ও সংযোগ সড়ক এশিয়ান হাইওয়ে রুট এ এইচ-১ এর অংশ হওয়ায় তা যথাযথ ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে । এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে । দেশের দক্ষিণাঞ্চল ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে ।
ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হবে এবং যাত্রী ও পণ্য পরিবহণে সুবিধা হবে । এডিবির সমীক্ষা বলছে, পদ্মা সেতু দিয়ে ২০০২ সালে ২৪ হাজার যানবাহন চলেছে । তার মধ্যে বাস, ট্রাক মাইক্রোবাস ও ব্যক্তিগত গাড়ি আছে । কিছু দিন মোটর সাইকেল চলাচল বন্ধ ছিল । এখন আবার চলাচল শুরু হয়েছে ।
সমীক্ষায় আরও প্রাক্কলন করা হয়েছে ২০২৫ সালে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে দিনে যানবাহন চলাচল বেড়ে দাঁড়াবে ২৭ হাজার ৮০০ টি। ২০৩০ সালে হবে ৩৬ হাজার ৭৮৫ টি । ২০৪০ সালে দিনে যানবাহন চলাচল বেড়ে দাঁড়াবে ৫১ হাজার ৮০৭ টি । যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন ।
পদ্মাসেতু অর্থনৈতিক গুরুত্বঃ
অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো অবকাঠামোগত উন্নয়ন । অবকাঠামোর উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে উন্নয়নের গতি লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে । বিদ্যুৎ ও গ্যাসের পর্যাপ্ততা, যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন বিশেষ করে নিরাপদ ও টেকসই সড়ক ব্যবস্থা, দ্রুত ও আরামদায়ক নৌপথ মানুষের জীবনমান উন্নত করে , অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে ।
পদ্মাসেতু নির্মাণ আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়নের অন্যতম মাইলফলক । জাতিসংঘের ঘোষিত ১৫ বছর মেয়াদি এসডিজি বাস্তবায়নে বাংলদেশ কাজ করেছে । ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন রয়েছে । পদ্মা সেতু নির্মাণ সেই স্বপ্ন আরও সহজ । পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দেশেরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একুশ জেলার তিন কোটি মানুষ সুবিধা ভোগ করছে । যেমন পটুয়াখালীতে পায়রা সমুদ্র বন্দর তৈরি হচ্ছে । এছাড়া মংলা সমুদ্র বন্দর আগের থেকে এখন অনেক বেশি অর্থনৈতিক কর্মকান্ড হচ্ছে ।
পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে নানান শিল্প, পর্যটন কেন্দ্র । যা বলা যায় পদ্মা সেতুর প্রত্যক্ষ ফল । এসব সারা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে গতি সঞ্চর করবে । পদ্মা সেতু নির্মাণে গ্রাম ও শহরের অর্থনেতিক দূরত্ব কমে আসছে । পরিবহন ব্যবস্থাপনা, কৃষি ও শিল্পায়নের বৈপ্লবিক পরির্বতন শুরু করেছে । সেতুটি নির্মাণের ফলে সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত হয়েছে । এর ফলে ভুটান নেপালের সাথে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বেড়েছে । সেতুর দুই পাশে অর্থনৈতিক অঞ্চল , হাইটেক পার্ক, শিল্প কারখানাসহ কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত কাজে নানা কারখানা তৈরি হচ্ছে ও হবে ।
বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে । দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পর্যটন শিল্পের বিকাশেও সেতুটি অনেক বেশি কাজে এসেছে । অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের আয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে । কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই অঞ্চলের খামার মালিকদের অনেক বেশি লাভবান হচ্ছে । আর্থিক সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে । পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শুধু একুশটি জেলা নয় বরং সারা দেশের মানুষ নানাভাবে উপকৃত হচ্ছে । কৃষি পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে ।
কৃষকরা দ্রুত ঢাকায় কৃষি পণ্য পৌঁছতে পারছে । এতে করে পদ্মা সেতুর কারণে অর্থনৈতিক একটা গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে । দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের আয় দ্বিগুণ হচ্ছে । পদ্মা সেতু নির্মাণে সাত আট হাজার শ্রমিক কাজ করেছিল । এসব শ্রমিক এক সময় বেকার ছিল । সেতু নির্মাণ কাজের সাথে তারা জড়িয়ে নিজেরা হয়েছে দক্ষ ।
এই দক্ষতা কাজে লাগিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের পরবর্তী সময়ে তারা এখন অনেক জায়গায় দক্ষতার সাথে কাজ করেছে । পদ্মা সেতুর ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ যাতায়াত ব্যবহার যুগান্তকারী পরিবর্তন হয়েছে । গ্রামীণ অর্থনীতির গতিশীল হয়েছে । যার ফলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে ।
উপসংহারঃ
স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে গৃহীত সর্ববৃহৎ প্রকল্প পদ্মা সেতু আজ বাস্তব রূপ লাভ করেছে । দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা, দরিদ্র্যের কশাঘাত মুক্ত উন্নত জীবনের স্বপ্ন এখন দৃঢ় সত্যের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অর্থনীতিই বদলে দেবে । এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ।
বি:দ্র: লেখার জন্য অনেক বই ও অনলাইন লেখার সাহায্য নেওয়া হয়েছে ।